“হারুন রেসিডেন্স” বহুতল ভবনে সবুজের সমারোহ

লেখকঃ শফিক রাহমান

 

ভবনের বিভিন্ন তলায় গ্রিন টেরাস তৈরি করার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি অর্জন করেছে এক অভিনব বৈশিষ্ট্য। বাগানটিতে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল ও ফুলের শৌখিন চাষাবাদ করতে পারছেন ব্যবহারকারী। একই সঙ্গে আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যকে খুব কার্যকর ও বৈজ্ঞানিকভাবে ডিজাইন করার কারণে ভবনটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক আলো ও বায়ুপ্রবাহের অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে।


  বাংলাদেশ আয়তনে ক্ষুদ্র অথচ অন্যতম জনবহুল দেশ। স্বল্পভূমিতে অধিক জনসংখ্যার আবাসস্থলের সংস্থান তাই অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য অবস্থার সৃষ্টি করে। বিশেষত, নগর অঞ্চলে জমির উচ্চমূল্যের কারণেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভবনের নির্মাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্মাণ এবং বহুতল ভবনের পরিকল্পনা করে থাকে। গ্রাহকের চাহিদা, জনসংখ্যার উচ্চ সংকুলান ও অর্থনৈতিক কারণে শহর অঞ্চলের ভবনের নকশায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ খোলা জায়গা রাখাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থপতি ও প্রকৌশলীদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করেও স্থাপত্যে খোলা জায়গা এবং সবুজ প্রাঙ্গণকে এক ভিন্ন মাত্রায় ধারণ করে নকশাকৃত প্রকল্প ডা. হারুন রেসিডেন্স।

মিশ্র ব্যবহারিক (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) এই প্রকল্পটির ফ্যাংশনাল চাহিদা ছিল অত্যন্ত বেশি। একজন চিকিৎসক হিসেবে গ্রাহক, ডা. হারুন উর রশিদ একই সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র মাত্রার চিকিৎসাকেন্দ্র, নিজস্ব বাসভবন এবং কিছু ফ্লোর রেসিডেন্সিয়াল হিসেবে ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ঠিক সেভাবেই ভবনের নিচের ফ্লোরগুলো চিকিৎসাকেন্দ্র এবং ওপরের ফ্লোরগুলো আবাসস্থল হিসেবে ডিজাইন করা হয়। উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই প্রকল্পে খুব সামান্য ভূমিরমধ্যেও রেসিডেন্সিয়াল ও ক্লিনিকের ব্যবহারকে আলাদা করে এন্ট্রি-এক্সিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিশ্র ব্যবহার প্রকল্পের অন্যতম স্থাপতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ভবনের বাহ্যিক রূপে পরিস্ফুটিত হয় অভ্যন্তরীণ দুটি ভিন্ন ব্যবহারিক বিশেষত্ব।

ভবনটির অভ্যন্তরীণ বিন্যাস ও নকশায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রাখে প্রকল্পের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ভবনের প্রবেশমুখে ডিজাইন করা হয় তিনতলাবিশিষ্ট একটি এট্রিয়াম স্পেস, যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ নিশ্চিত করে এট্রিয়াম স্পেসটি ভবনের প্রবেশমুখে যেমন একটি ইনডোর কমিউনিটি স্পেস হিসেবে কাজ করছে, একই সঙ্গে এট্রিয়ামটি তিনটি তলার বিভিন্ন অংশকে দৃশ্যত সংযুক্ত করে স্থাপতিক নান্দনিকতার সম্পূর্ণতা দান করেছে। এই ভবনের বাইরে থেকে দৃশ্যমান এই এট্রিয়ামটি ভবনের অভ্যন্তরীণ পাবলিক ফ্যাংশনকে একজন পথচারীর সঙ্গে দৃশ্যত সংযুক্ত করে। সুচিন্তিতভাবে লুভরের ব্যবহার বৃষ্টি ও রাস্তার ধুলাকে প্রতিহত করছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করে অসাধারণ এক অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ভবনের স্থাপত্যে।

বহুতল ভবনটির ওপরের ফ্লোরগুলোতে ডিজাইন করা হয়েছে আবাসিক অংশটির। চতুর্থ তলায় নকশায় অন্তর্ভুক্ত হয় গ্রাহকের নিজস্ব আবাসস্থল। এই ফ্লোরটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অভিনব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে চতুর্থ তলায় বিশাল আকারের একটি পারিবারিক বাগান ও বৃষ্টি বারান্দা সংযুক্ত করে। ভবনের সম্মুখভাগে প্রধান শয়নকক্ষের সাথে এই ৩৫০ বর্গফুটের বাগানটি আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার ফলাফল। ছাদ ওপরে উন্মুক্ত না রেখেও এই বাগানটি গাছগুলোর টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রোদ ও আলো নিয়ে আসে অভ্যন্তরীণ স্পেসে। বাগানটিতে প্রাকৃতিকভাবে গাছপালার বেড়ে ওঠার জন্য সক্রিয়ভাবে পানি দেওয়া ও পানি নিষ্কাশনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে, ব্যবহারকালীন বাগানটি এই পরিবারের বৈকালিক বিনোদন, আড্ডা ও পারিবারিক মিলনের জায়গায় পরিণত হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলায় গ্রিন টেরাস তৈরি করার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি অর্জন করেছে এক অভিনব বৈশিষ্ট্য। বাগানটিতে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল ও ফুলের শৌখিন চাষাবাদ করতে পারছেন ব্যবহারকারী।

ভবনটির নকশায় গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান পায় রিসোর্সের পরিমিত ব্যবহার, যা পরিবেশবান্ধব নির্মাণের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। রেসিডেন্সিয়াল ফ্লোরগুলোর নকশায় পশ্চিম পাশে টয়লেট, কিচেন ও বেলকনি ডিজাইন করে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাকে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। জানালাগুলো সঠিক পরিমাণ শেডিং ডিজাইনের মাধ্যমে সূর্যের প্রখরতাকে রোধ করে। একই সঙ্গে প্রতিটি কক্ষে রয়েছে ক্রস ভেন্টিলেশন, যার ফলে স্বাস্থ্যকর, উন্মুক্ত অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে চতুর্থ তলার অভিনব সবুজ বাগানটি ছিল পরীক্ষামূলক, কিন্তু নির্মাণের পর এই বাগানটি সার্থকভাবে কাজ করছে। এই বাগানটি বসবাসকারীর জন্য বহুতল ভবনেও এনে দিয়েছে সবুজ ও পরিবেশের মাঝে বসবাসের প্রশান্তি। বসন্তে হলুদ গাঁদা, শীতের লাল গোলাপ, অথবা উঠানের গাছে মৌসুমি ফলের আনাগোনা, শহরের যান্ত্রিক জীবনে এটি ঠিক যেন স্বদেশীয় স্থাপত্যে জীবনযাত্রার নান্দনিক প্রতিফলন।
  এক নজরে
ভবনের ধরন: মিশ্র ব্যবহার (আবাসিক ও বাণিজ্যিক)
প্রকল্পের অবস্থান: রাজশাহী জায়গার পরিমাণ: ৬ দশমিক ১৫ কাঠা (৬.১৫ × ৭২০) ৪৪২৮ বর্গফুট নির্মিত
স্পেসের পরিমাণ: ২৩ হাজার ১৫০ বর্গফুট নির্মাণকাল: ২০১২-২০১৪
প্রধান স্থাপতি: স্থপতি শফিক রাহমান
স্থাপতিক ডিজাইন প্রতিষ্ঠান: ত্রিকোণ স্থপতি (http://trikonarchitects.com/)
কাঠামো নকশা প্রণয়ন: প্রকৌশলী আবু মুসা
গ্রাহক: ডা. হারুন উর রশিদ
  স্থপতি শফিক রাহমান প্রভাষক,
স্থাপত্য বিভাগ
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আলোকচিত্র: ত্রিকোণ স্থপতি