পোষাকে ও ভূষণে স্থপতি

শফিক রাহ্‌মান


স্থাপত্য বিষয়ক মাসিক প্রকাশনা বন্ধন , ইসু ৬৭, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
নির্দিষ্ট কিছু পেশা রয়েছে যেখানে পোশাক পেশার প্রতিফলন। যেমন একজন আইনজীবী বা বিচারক; একধরনের কাল গ্রাউন পরেন, যেটা ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রচলিত এবং বর্তমানে এই পেশার জন্য আইনগত ভাবে বাধ্যতামূলক পোশাক। একজন আইনজীবীর এই পোশাকের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ঠিক তেমন একজন ডাক্তার-এর পোশাক তার পেশার বৈশিষ্ট্য বহন করে। যেমন অসংখ্য পেশার জন্য রয়েছে নিদিষ্ট পোশাক, তেমন অসংখ্য পেশায় নির্ধারিত নেই কনও বিশেষ ভূষণ। অত্যন্ত বেতিক্রমধর্মী একটি পেশা স্থপতি, কিন্তু স্থপতির জন্য পেশাগত ভাবে নির্ধারিত নেই কোনও বিশেষ পোশাক। তবে কেমন হওয়া উচিত একজন স্থপতির পোশাকি ভাষা?
বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ-কথন, “আগে দর্শন ধারী, পরে গুন বিচারী”। সভ্যতার সাথে সাথে পোশাক মানুষের নিজেকে উপস্থাপনের সর্বপ্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, তা অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। একজন স্থাপতির ক্ষেত্রে নিজেকে উপস্থাপন কতটুকু জরুরি সে বিষয়ে দেখতে গেলে, পোশাক গণ্য হোক বা না হোক, কিন্তু তার কথা বলার বা নিজের কাজ কে কথায় উপস্থাপন করাটা সর্বকালেই স্থাপত্তের অপরিহার্য একটি অংশ হয়ে রয়েছে। স্থাপত্য শিক্ষার শুরু থেকেই উপস্থাপনা স্থাপত্য শিক্ষার একটি অবিছেদ্য অংশ। সারা বিশ্বে স্থাপত্য শিক্ষায় “জুরি” হিসেবে পরিচিত যে বিষয়টি, তা প্রোজেক্ট, আইডিয়া বা গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনার পাশাপাশি, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌখিক উপস্থাপনা। স্থাপত্য শিক্ষায় এই উপস্থাপনা কে অপরিহার্য একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করার পিছনে নিঃসন্দেহে যে বিষয় টি যুক্ত রয়েছে, তা হোল একজন স্থাপতির পেশাগত জীবন। যেখানে একজন স্থপতি প্রতিনিয়ত সম্মুখিন হন উপস্থাপনার, কথা বলার, ব্যাখ্যা করার এবং নেতৃত্ব দিবার। তাই পোশাকে সুনিদিষ্ট কনও বাঁধা-ধরা নিয়ম না থাকলেও, একজন স্থাপতি একজন নিত্যদিনের উপস্থাপক, সে বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই কনও ভাবেই।
ঐতিহ্যগত ভাবেই তাই স্থপতির সাথে, স্থাপত্য চর্চার সাথে, উপস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে। উপস্থাপনা একটি বিস্তৃত বিষয়। উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্য নিয়ে রয়েছে অসংখ্য গবেষণা।একজন উপস্থাপক কি উপস্থাপন করছেন তা যেমন উপস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই গুরুত্ব বহন করে তার উপস্থাপনার কৌশল। উধারহন হিসেবে বলা যায়, যেমন ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথলেস এর ওয়েবসাইট-এ শিক্ষার্থীদের উপস্থাপনার কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, উপস্থাপনার সময় শারীরিক ভাষার দিকে লক্ষ রাখাটা জরুরী, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, তাকানোর ভিতরেও থাকা উচিৎ সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যা শ্রোতার আকর্ষণকে ধরে রাখে। গবেষক রিসেল ডেবিস তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, মৌখিক উপস্থাপনা শুধুমাত্র কি উপস্থাপন করা হচ্ছে তা নয়, খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে এটি কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার উপরে নির্ভরশীল। তিনি আরও বলেছেন গলার স্বর নিয়ে, ভঙ্গিমা নিয়ে। উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্য নিয়ে রয়েছে এমন আরও অসংখ্য গবেষণা। কিন্তু উপস্থাপনার সাথে পোশাক এর গুরুত্ব কতটুকু, আর কিভাবে পোশাক উপস্থাপন করে উপস্থাপক কে তা নির্ধারণ করাটাই ব্যাখ্যা করতে পারে একজন স্থপতির পোশাক ও ভূষণ।
উপস্থাপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পোশাক কে নির্দেশ করেছে আমেরিকার দি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস। একটি লেসন-এ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রফেশনাল ড্রেস-আপ একজন শিক্ষার্থীর উপস্থাপনার গুন কে বাড়িয়ে দেয়, উপস্থাপক কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে তার শ্রোতার কাছে। একজন উপস্থাপক এর পোশাক তার শ্রোতার বা দর্শক এর উপরে প্রভাব বিস্তার করে। যদিও সকল ধরনের উপস্থাপনার পোশাক এক রকম নয়। পথে গান শুনিয়ে যে উপার্জন করে, তার পোশাক আর একজন রাষ্ট্রপতির পোশাক কখনই একি নয়। কিন্তু কাজের সাথে, উপস্থাপনার জায়গা, মূল্যমান হিসেবে পোশাক সঙ্গতিপূর্ণ হওয়াটা জরুরী। দি প্রেজেন্টেশান ম্যাগাজিন উপস্থাপনার সাথে পোশাকের সামঞ্জস্য নিয়ে একটি প্রবন্ধে লেখেছে, “গবেষণায় দেখা গেছে উপস্থাপনার প্রথম প্রভাবক হিসেবে যা কাজ করে তা কথা নয়, তা হলও একজন উপস্থাপক কে সর্বোপরি দেখতে কেমন লাগছে তা”। অর্থাৎ একজন উপস্থাপকের পোশাক তার উপস্থাপনায় অনেক বড় একটি গুরুত্ব বহন করছে। সে অর্থে এটা একজন স্থপতির ক্ষেত্রেও বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য, যেহুতু একজন স্থপতি একজন নিত্যদিনের উপস্থাপক। অর্থাৎ সুনিদিষ্ট কনও পোশাক না থাকলেও একজন স্থাপতির হওয়া উচিত পোশাক সচেতন। আর এই বিষয়টি আরও বুহুগুলে পরিস্ফুটিত হয়েছে কালে কালে, মডার্ন, পোস্ট-মডার্ন থেকে শুরু করে কনটেম্পোরারি স্থপতিদের বেশ ও ভূষণে।
১৮০০ সালের প্রথম থেকে, বর্তমান সময়ের নামী স্থপতিদের অধিকাংশ ছবিতে দেখা যায় কোর্ট, শার্ট এবং টাই কে প্রাধান্য দিতে। ছবিতে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর ২০টি দেশের বিভিন্ন সময়ের স্থপতিদের প্রট্রেট থেকে ধারনা করা যায় তাদের পোশাকের প্রাধান্য। এবং একি সাথে এই বিষয়টিও পরিষ্কার হয় যে নিজেকে উপস্থাপনকে স্থপতিরা গুরুত্ব দিয়েছেন সব সময়। উপমহাদেশ এর স্থাপতি দের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়, স্বদেশীও পোশাকের পাশাপাশি, গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে ফর্মাল পোশাক নির্বাচন করতে।
মার্জিত পোশাক এবং সঠিক পোশাকের নির্বাচন যেকোনো মানুষকেই আত্মবিশ্বাস অর্জনে সহযোগিতা করে। এবং একজন স্থপতির জন্য এই আত্মবিশ্বাস আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কারন পেশাগত ভাবে উপস্থাপনা তার নিত্যদিনের সঙ্গি। আর পোশাকের গুরুত্ব শুধু পেশাগত জীবনে নয়, এটি একজন স্থাপত্যের শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রিতিক সময়ে জনপ্রিয় স্থাপত্য বিষয়ক ওয়েবসাইট আর্ক-ডেইলি “একজন স্থপতির পোশাক” বিষয়ক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে, যেখানে গ্রহণযোগ্য শার্ট, গ্রহণযোগ্য প্যান্ট বা রং সম্পর্কে নির্ধারিত করে বলা হয়েছে। পোশাক অবশ্যই একজন স্থপতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা দেখেছি, কিন্তু কন ধরনের পোশাক বা কন রং এর পোশাক তা নির্ধারিত করে বলাটা যুক্তি নির্ভর নয়। পোশাক সংস্কৃতির একটা অনেক বড় অংশ। একটি দেশের স্থাপত্য যেমন তার ঐতিহাসিক, স্বদেশীও এবং আবহাওয়া গত বৈশিষ্টের উপর নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি একটি দেশের পোশাক তার সংস্কৃতির এবং আবহাওয়াগত বৈশিষ্টের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এবং একজন স্থাপতির কাজে যেমন স্বদেশীও বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়, ঠিক পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রতিফলন থাকা উচিত স্বদেশীও বৈশিষ্টের। একি সাথে উপলক্ষ বা আনুষ্ঠানিক দিকটি পোশাক নির্বাচনে স্থাপতিরা প্রাধান্য দিয়েছেন। স্বদেশী বা বিদেশী, পোশাক এর ধরন, বরন অথবা রং একটি বেক্তিগত পছন্দের বিষয়, কিন্তু যেকোনো পোশাকের ভিতরেই উঠে আসতে পারে মার্জিত ভাব এবং উপযুক্ত উপস্থাপনা, যা একজন স্থপতির নেতৃত্ব গুনকে এবং আত্মবিশ্বাস কে বাড়িয়ে দেয় বহু গুনে।
লেখক - শফিক রাহ্‌মান, দি ইউনিভার্সিটি অব সিডনি তে স্থাপত্যে মাস্টার্স এর শিক্ষার্থী।