আধুনিক স্থাপত্যের এক ব্যতিক্রমী স্রষ্টা জাহা হাদিদ

স্থাপত্য বিষয়ক মাসিক প্রকাশনা বন্ধন ইস্যু ৭৩।

লেখকঃ শফিক রাহমান

ভবনের মসৃণ দেয়াল, অভ্যন্তরীণ স্পেসের অনির্দিষ্ট আকার ও আলো-ছায়ার খেলায় জাহা হাদিদ তাঁর স্থাপত্যে সৃষ্টি করেছেন মনোমুগ্ধকর এক ইন্দ্রজাল। তাঁর এই বিশেষত্ব কিন্তু কোনো আবেগ-নির্ভর সৃষ্টি নয়। তাঁর কাজের এই অসংজ্ঞায়িত ভিন্ন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের গভীরে রয়েছে বিজ্ঞান, সূত্র, বিশেষ ধারণা এবং স্থাপত্যিক দর্শন।

স্থাপত্যের পরিসর এতটাই বিস্তৃত, যাকে কোনো একক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আক্ষরিক অর্থে ভবন, শহর বা অঞ্চলের পরিকল্পনা ও ডিজাইন হিসেবে স্থাপত্যকে সংজ্ঞায়িত করা হলেও স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের জীবন, সমাজ, পরিবেশ, অর্থনীতি, মানসিক অবস্থা, চাহিদা, শহর, অবকাঠামো, জলবায়ু, ভূমি ও প্রাসঙ্গিক আরও কিছু বিষয়। তাই স্থাপত্য চর্চায় একেকজন স্থপতির রয়েছে ভিন্ন দর্শন ও মাত্রা। কালের আবর্তে যেসব স্থপতি তাঁদের কাজ ও সৃষ্টি দিয়ে স্থাপত্য ও সভ্যতাকে বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের মাঝে অবিস্মরণীয় নাম জাহা মোহাম্মাদ হাদিদ বিশ্ব বরেণ্য এই স্থপতি গত ৩১ মার্চ, ২০১৬ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে হয়েছেন অনন্তের পথযাত্রী, পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন তাঁর বিস্ময়কর সব স্থাপত্য সৃষ্টি।

জাহা হাদিদের জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯৫০ সালে, ইরাকে। প্রথমে গণিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী হলেও পরবর্তী সময়ে আর্কিটেকচার অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার, লন্ডন থেকে স্থাপত্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন। ২০০৪ সালে প্রথম মুসলিম নারী স্থপতি হিসেবে স্থাপত্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি প্রিটকজার আর্কিটেকচার পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯৭২-২০১৬ এই ৪৪ বছরের স্থাপত্য চর্চায় জাহা হাদিদ নিজেকে নিয়ে যান ভিন্ন এক উচ্চতায়, যা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বাহ্যিক দৃষ্টিতেও তাঁর কাজকে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায় ব্যতিক্রমী ফর্ম ও জ্যামিতিক খণ্ডিত ধরনের কারণে। ভবনের মসৃণ দেয়াল, অভ্যন্তরীণ স্পেসের অনির্দিষ্ট আকার ও আলো-ছায়ার খেলায় জাহা হাদিদ তাঁর স্থাপত্যে সৃষ্টি করেছেন মনোমুগ্ধকর এক ইন্দ্রজাল। তাঁর এই বিশেষত্ব কিন্তু কোনো আবেগ-নির্ভর সৃষ্টি নয়। তাঁর কাজের এই অসংজ্ঞায়িত ভিন্ন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের গভীরে রয়েছে বিজ্ঞান, সূত্র, বিশেষ ধারণা এবং স্থাপত্যিক দর্শন। তাঁর প্রতিটি কাজের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি ও দৃঢ় আধুনিক স্থাপত্যিক চেতনা।

জাহা হাদিদের স্থাপত্য প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ প্রকৃতির উপাদান যেমন গাছ, পানি বা একটি জায়গার ভূমির গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের মতো, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের অবস্থানগত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর স্থাপত্যে এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফর্ম ও স্পেস শুধুই বাহ্যিক অবকাঠামোতে নয়, বরং তাঁর স্থাপত্যিক চেতনার মূলে রয়েছে আরও গভীর, যৌক্তিক ও শৈল্পিক কার্যকারণ। জাহা হাদিদ স্থাপত্যে যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেছেন তাকে স্থাপত্যচর্চার বিশেষ কিছু ধারায় সংজ্ঞায়িত করতে পেরেছেন গবেষক ও বিশ্লেষকেরা। উনিশ শ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্থাপত্যে বিশেষ এক ধারার আবির্ভাব হয়, যা পোস্ট-মডার্ন আর্কিটেকচার হিসেবে সংজ্ঞায়িত। পোস্ট-মডার্ন আর্কিটেকচারের বিকাশমান ধারার একটি পর্যায় ডিকনস্ট্রাক্টিভিসম।

১৯৮০-এর দশকে এই বিশেষ ধারার স্থাপত্য দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। জাহা হাদিদের প্রারম্ভিক স্থাপত্য চর্চায় ডিকনস্ট্রাক্টিভিসমের প্রভাব লক্ষণীয়। স্থাপত্যে এই ধারা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মডার্ন আর্কিটেকচারের সরল সাধারণ প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে স্থাপত্যে অনন্য বৈশিষ্ট্য আনা। পোস্ট-মডার্ন আর্কিটেকচারের অনুশীলন শুরু হয় মডার্ন আর্কিটেকচারের কিছু ধরাবাঁধা নিয়মকে অতিক্রম করে নতুনত্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। মডার্ন আর্কিটেকচার স্থাপত্যের অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হলেও, এই ধারার স্থাপত্য সারা বিশ্বে একই ধরনের সাদৃশ্যপূর্ণ ডিজাইনের জন্ম দেয়। অথচ প্রতিটি স্থাপত্য হওয়া উচিত ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এবং ভূমি, জলবায়ু ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় মডার্ন আর্কিটেকচারে। তাই মডার্ন আর্কিটেকচারের এই সরল অথচ অনুরূপ বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে স্থাপত্যে একটি নতুন ধারার সূচনা করেন কিছু স্থপতি, যা পোস্ট-মডার্ন হিসেবে পরিচিতি পোস্টমডার্ন আর্কিটেকচার বিকাশের বিশেষ একটি পর্যায় ডিকনস্ট্রাক্টিভিসম। ডিকনস্ট্রাক্টিভ আর্কিটেকচারে স্থাপত্যের কাঠামো, ফর্ম, বহিরাবরণ ও স্পেসকে নিয়মিত বর্গাকার ও সরল জ্যামিতিক আকৃতি থেকে পরিবর্তন করে একটি নতুন ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবস্থা দেওয়া হয়। বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রতিটি স্থাপত্যকে তার নিজস্ব চরিত্র দান করা ছিল ডিকনস্ট্রাক্টিভিসম ধারণার অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই এই ধারায় স্থাপত্য পেয়েছে ভিন্ন মাত্রার ফর্ম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অবয়ব ডিকনস্ট্রাক্টিভিসম ধারার সূচনা ও বিকাশের পেছনে রয়েছে আরও গভীর দার্শনিক চিন্তা ও গাণিতিক বিশ্লেষণ। ডিকনস্ট্রাক্টিভিসকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ নতুন এক মাত্রা দেন স্থপতি জাহা হাদিদ। তাঁর স্থাপত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্ভ ফর্ম, কার্ভ গ্রাফিক্স এবং অসংজ্ঞায়িত কারভেচার স্পেস সৃষ্টির মাধ্যমে ডিকনস্ট্রাক্টিভ ধারাকে উপস্থাপন করে, যা স্থাপত্যের ইতিহাসে এনেছে ভিন্ন এক মাত্রা ও সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা। একই সঙ্গে ভবনের অভ্যন্তরীণ স্পেসে আলো-ছায়ার মায়াজাল সৃষ্টিতে অনবদ্য স্থপতি জাহা হাদিদ। ফাংশন বা ব্যবহারের উপযোগিতা যাতে কখনোই ব্যাহত হয়নি। তাঁর ডিজাইনে সব সময়য়ই প্রাধান্য পেয়েছে, স্থাপত্যটির সাইটের টপগ্রাফি, ল্যান্ডস্কেপ আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ।কিংবদন্তি স্থপতি জাহা হাদিদ প্রায় ডিজাইন করেছেন ৯৫০টি প্রকল্প। তাঁর নির্মিত প্রকল্প সংখ্যা ৮২। তাঁর ডিজাইনের বৈচিত্র্য এমনই, যা তাঁকে সারা বিশ্বে স্বনামেই পরিচিত করে তুলেছে। এই অসাধারণ কৃতিত্ব ও স্থাপত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন ৯৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, তবে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থাপত্যকর্ম পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে সহস্র বছর।
  স্থপতি শফিক রাহমান
প্রভাষক, স্থাপত্য বিভাগ
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়